নিজস্ব প্রতিনিধি,রামগঞ্জ কন্ঠ,২জুনঃ গৃহকর্ত্রী কর্তৃক নির্মম নির্যাতনের পর মৃত মনে করে রাঙ্গামাটি সীমান্তের লিচুবাগানে ফেলে দেওয়া গৃহকর্মী নিলুফা’র জীবন বাঁচিয়ে নেটিজেনদের প্রশংসায় ভাসছেন চট্টগ্রামের এএসপি (রাঙ্গুনিয়া- রাউজান সার্কেল) মো. আনোয়ার হোসেন শামীম।
ঘটনার পরপরই তার নেতৃত্বাধীন পুলিশ ফোর্স মুমূর্ষু অবস্থায় থাকা কিশোরীটিকে সেখান থেকে উদ্ধার করে সময়মতো উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে প্রাণ রক্ষা পায় তার। গত (৩১ মে) দুপুরে ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা করে এএসপি আনোয়ার শামীম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘৯৯৯ এর একটি কল এবং ‘মৃত’ গৃহকর্মী নিলুফা বেগমের বেঁচে ফেরার ইতিহাস’ শিরোনামে একটি পোস্ট করলে তা নেটিজেনদের মাঝে প্রশংসার ঝড় তোলে।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরীর হামজারবাগ এলাকার বাসিন্দা সেলিম-সুমি দম্পতির বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতো বছর পনেরোর কিশোরী নিলুফা। গৃহকর্ত্রী সুমি বিভিন্ন অজুহাতে প্রায়শই নিলুফার ওপর নির্মম নির্যাতন চালাতেন। গত ২৭ মে সকালে নির্যাতনের এক পর্যায়ে নিলুফা অজ্ঞান হয়ে পড়লে তাকে মৃত ভেবে বাড়ির দারোয়ান আকবর আলীর সহায়তায় জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলাধীন লিচুবাগান এলাকার একটি যাত্রী ছাউনিতে ফেলে রেখে যান সুমি।
সেখানে মেয়েটিকে অসাড় অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে জনৈক ব্যক্তি ৯৯৯ এ ফোন করে জানালে এএসপি আনোয়ার হোসেন শামীম’র নেতৃত্বে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে। মেয়েটি তখন অর্ধমৃত। পুরো শরীর ক্ষতবিক্ষত, কথাও বলতে পারে না। এ অবস্থায় তিনি চাইলে মেয়েটিকে নিকটস্থ সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করতে পারতেন। মরা-বাঁচা দেখার দায়িত্ব তো আর পুলিশের নয়।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনার পর চিকিৎসকেরা রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে অতি দ্রুত তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু পরিবার- স্বজনহীন অজানা অচেনা এই মেয়েকে এম্বুলেন্স ভাড়া করে কে নিয়ে যাবে ৫০ কিলোমিটার দূরের এই হাসপাতালে! সাহায্য চেয়ে কয়েকটি ব্যক্তি-সংস্থার সাথে কথা বলে হতাশাই মেলে উদ্ধারকারী এএসপি আনোয়ার শামীমের।
এদিকে অবনতিশীল পরিস্থিতিতে থাকা হতভাগা কিশোরী নিলুফা তখন ‘প্রায়’ অচেতন থেকে ‘পুরোপুরিই’ অচেতন। চিরদিনের জন্য অচেতন হবার দিকেও হয়তো ধাবিত হচ্ছে দ্রুতই। সুতরাং যা করার করতে হবে দ্রুত। শেষমেশ কোন উপায়ান্তর না পেয়ে তিনি এবং তার কয়েকজন সহকর্মী পুলিশ সদস্য ব্যক্তিগত খরচে একটি এম্বুলেন্স ভাড়া করে মেয়েটিকে নিয়ে রওনা হয়ে যান চট্টগ্রাম মেডিকেলের উদ্দেশে।
চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা শুরুর আগে ডাক্তারেরা নিয়ম মোতাবেক ‘রোগীর অভিভাবক কে’ তা জানতে চাইলেন। কিন্তু যে অজানা অচেনা মেয়েকে মুমূর্ষু অবস্থায় রাস্তা থেকে উদ্ধার করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে, যে মেয়ে কথা বলা দূরে থাকুক ডাকাডাকি করলেও ন্যূনতম সাড়া দেয় না, তার আবার অভিভাবকের হদিস মিলবে কোথা থেকে। কিন্তু এদিকে চিকিৎসা শুরু করতে তো অভিভাবক লাগবেই। আবার দায়িত্ব নিলেন তিনি। মেয়েটি মরে গেলে সেই লাশ তার জন্য অনেক বড় গলার কাঁটা হয়ে দাড়াতে পারে, তা জেনেও বলে দিলেন ‘আমিই এই মেয়ের অভিভাবক’। রাস্তায় পড়ে থাকা নাম পরিচয়হীন মুমূর্ষু কিশোরীর অভিভাবক একজন এএসপি।
চিকিৎসা শুরু হয়ে গেল। সর্বাগ্রে জরুরিভিত্তিতে রোগীর দুই ব্যাগ রক্ত লাগবে। ডোনার ম্যানেজ করে রক্ত পাওয়া সময়সাপেক্ষ, সময়ও নেই। রক্তটাও তাই কিনতেই হবে। কিন্তু ‘কে কিনবে’ এই প্রশ্ন জাগার আগেই প্রয়োজনীয় টাকা পরিশোধ করে দিলেন এএসপি আনোয়ার শামীম। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, অন্যান্য সামগ্রী সবকিছুও একইরকম বিনাবিলম্ব এবং বিনাবাক্যব্যয়ে কিনে আনছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
তখনও মেয়েটির বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনের কোনরকম সন্ধান নেই। বাপমায়ের ভূমিকায় তখন পুলিশ। তারাই ট্রলি ঠেলে রোগীকে জরুরি বিভাগে নিচ্ছেন, টিকিট কাটছেন। তারাই ডক্টরস রুমের সামনে সিরিয়ালে দাড়াচ্ছেন, বিভিন্ন কার্যক্রমে রোগীকে নিয়ে এক ওয়ার্ড থেকে অন্য ওয়ার্ডে ছোটাছুটি করছেন। আপনজন রূপে মেয়েটির মাথায় তেল মাখিয়ে দেওয়া, একটু প্রকৃতস্থ হলে পথ্য খাওয়ানোর কাজটিও করছেন পুলিশ সদস্যরাই।
সেবাযত্ন ও চিকিৎসার এক পর্যায়ে নিলুফা চোখ মেলে তাকায়। প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মতো পরিস্থিতিও হয়। তার কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে বাবামায়ের ঠিকানা নেওয়া সম্ভব হয়। তারপর ওই এলাকার পুলিশের সহায়তায় তাদেরকে দ্রুত খুঁজে বের করে হাসপাতালে নিয়ে আসার ব্যবস্থাও করা হয়। বাবা-মা এসে অশ্রুসিক্ত নয়নে পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে মেয়েকে বুঝে নিলেন ঠিকই, কিন্তু পরবর্তী চিকিৎসা নিশ্চিত করার মতো আর্থিক সঙ্গতি তাদের নেই। এবারও ত্রাতার ভূমিকায় এএসপি। তিনি চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপারের সাথে কথা বললে তিনি ( পুলিশ সুপার) নিলুফার ওষুধ পথ্যসহ সকল খরচ বহনের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন। শুধু তাই নয়, সাথেসাথে বাহক মারফত পাঠিয়ে দেন নগদ ৫০০০ টাকা।
চিকিৎসা তো চলছে। কিন্তু এতটুকুন একটা মেয়ের এমন জঘন্য হাল যারা করেছে, তাদের বিচার কি হবে না? এ বিষয়েও নেওয়া হল ব্যবস্থা। নিলুফার সাথে কথা বলে নির্যাতনকারী পরিবার এবং তাদের অবস্থানসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু সম্পর্ক তথ্য নিয়ে নিলেন এএসপি আনোয়ার এবং সঙ্গীয় পুলিশ কর্মকর্তারা।
যার সূত্র ধরেই গত ৩০ মে রাঙ্গুনিয়া ও পাঁচলাইশ থানা পুলিশের অভিযানে চট্টগ্রাম নগরীর হামজারবাগ এলাকা থেকে আটক করা হয় নির্যাতনকারী জেসমিন আক্তার ওরফে সুমি, তার স্বামী মোহাম্মদ সেলিম এবং তাদের বাসার দারোয়ান ও সুমিকে সহায়তাকারী আকবর আলীকে।
এরপর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নিলুফা ও তার পরিবারকে পাচলাইশ থানা পুলিশের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে নিলুফার মা কোহিনূর বেগম আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। নির্যাতিত কিশোরী নিলুফাও সাংবাদিকদের সম্মুখে তার ওপর গৃহকর্ত্রী সুমি কর্তৃক মাসের পর মাস ধরে নির্যাতনের রোমহর্ষক বর্ণনা দেয়, যা দেশবাসী গত দু’দিনে দেখেছেন টেলিভিশনের পর্দায়।
এ প্রসঙ্গে এএসপি আনোয়ার হোসেন শামীম বলেন, মেয়েটি আসলে মুমূর্ষু অবস্থায় রাঙ্গুনিয়ার লিচুবাগান এলাকাস্থ যাত্রী ছাউনির ওপর পড়েছিল। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার এসএম রশিদুল হক পিপিএম স্যারের নির্দেশে আমরা মেয়েটিকে উদ্ধারসহ তার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। তার সুচিকিৎসা এবং ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে ভবিষ্যতেও আমরা তার পরিবারের সাথে একত্রে কাজ করব।